মঙ্গলবার, ২০২৫ Jun ২৪, ১০ আষাঢ় ১৪৩২
#
মহানগর মহানগর

সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণ

কর্পোরেট পলিটিক্সের গন্ধ, হাওয়ায় উড়ছে তিন হাসপাতালের স্বার্থ সংঘাত

টুয়েন্টিফোর টিভি
প্রকাশিত : বৃহস্পতিবার, ২০২১ সেপ্টেম্বর ০৯, ০২:২৮ অপরাহ্ন
#

চট্টগ্রাম নগরীর সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণের পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া স্থানীয় নাগরিক ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের দ্বিপক্ষীয় বিরোধের রাজনৈতিক দিক নিয়ে বেশ আলাপ হলেও এর নেপথ্যে ‘কর্পোরেট পলিটিক্স’ নিয়ে আলাপ হচ্ছে খুব সামান্যই। যদিও এর মধ্যে হাসপাতাল নির্মাণের পক্ষে ও বিপক্ষে থাকা নেতারা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের ইন্ধনে প্রভাবিত হওয়ার অভিযোগ তুলেছেন বিভিন্ন সময়। তবে এই বিষয়ে বরাবরই চুপ থেকেছে এই বিতর্কে জড়িয়ে যাওয়া কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। খবর-চট্টগ্রাম প্রতিদিন।

তবে প্রকাশ্যে না এলেও আড়াল থেকে সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণ ইস্যুতে এসব প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা রাখার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না হাসপাতাল নির্মাণের পক্ষ ও বিপক্ষে থাকা নেতাকর্মীরাও। তারা বলছেন, সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণের রাজনীতিতে দুই পক্ষের দৃশ্যমান বিরোধ যেমন আছে, তেমনি বিভিন্ন কর্পোরেট গ্রুপের ব্যবসায়িক লাভ-ক্ষতির হিসাবও এক্ষেত্রে অন্যতম প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে। এক্ষেত্রে ইউনাইটেড গ্রুপ তো বটেই, ঘুরে ফিরে আলোচনায় আসছে চট্টগ্রামে বড় অংকের পুঁজি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত ইম্পেরিয়াল হাসপাতাল আর এভারকেয়ার হাসপাতালের নামও।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) এর আওতায় বাংলাদেশ রেলওয়ের সঙ্গে ইউনাইটেড এরন্টারপ্রাইজ লিমিটেডের ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল এবং ১০০ আসন বিশিষ্ট মেডিকেল কলেজ নির্মাণের জন্য ২০২০ সালের ১৮ মার্চ চুক্তি হয়। চুক্তিপত্র অনুযায়ী ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে হাসপাতালটি নির্মাণ করবে এবং ৫০ বছর পর হাসপাতালটি রেলওয়ের কাছে হস্তান্তর করবে— যা তখন সম্পূর্ণরূপে রেলওয়ে হাসপাতাল হিসেবে গণ্য হবে।

সিআরবির প্রাকৃতিক ও ঐতিহ্যগত অবস্থান অটুট রাখার দাবিতে গত দুই মাস ধরে এই হাসপাতাল নির্মাণের বিরোধিতা করছেন চট্টগ্রামের নাগরিকদের বড় একটি অংশ— যার অগ্রভাগে রয়েছেন প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নেতৃবৃন্দ। এর পাশাপাশি বিএনপি, সিপিবিসহ কিছু কিছু রাজনৈতিক দলও হাসপাতাল নির্মাণের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে।

তবে শুরু থেকে কোনো কোনো মহল থেকে বলা হচ্ছিল, এই বিরোধিতার পেছনে মূল কারণ কোনোভাবেই পরিবেশ রক্ষা নয়, বরং অন্য বেসরকারি হাসপাতালের স্বার্থে ইউনাইটেড গ্রুপের এই হাসপাতালটির বিরোধিতা করা হচ্ছে। আন্দোলনের শুরু থেকেই মৃদুভাবে এই আলাপ শোনা গেলেও এই বিষয়টিকে অনেকটাই প্রকাশ্যে তুলে আনেন চট্টগ্রামের চাঁন্দগাও-বোয়ালখালী আসনের সাংসদ ও দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোছলেম উদ্দিন।

সরাসরি এভারকেয়ার ও ইম্পেরিয়াল হাসপাতালের ইন্ধনে সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণের বিরোধিতা করা হচ্ছে— এমন দাবি করে মোছলেম উদ্দিন বলেন, ‘কিছু স্বার্থান্বেষী মহল এভারকেয়ার, ইমপেরিয়ালসহ বিভিন্ন হাসপাতাল মালিকদের ইন্ধনে সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণের বিরোধিতা করছে যা কাম্য নয়।’

মোছলেম উদ্দিন প্রকাশ্যে এমন অভিযোগ করলেও শুরু থেকেই এই আলাপ ছিল সবখানেই। কেন ইম্পেরিয়াল বা এভারকেয়ারের বিষয়ে এমন আলাপ হচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তরে নগর আওয়ামী লীগের এক নেতা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘মূলত এই দুটি হাসপাতালও সদ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এগুলোও অনেক বড় প্রকল্প ছিল। কিন্তু এক্ষেত্রে ইউনাইটেড সিআরবিতে হাসপাতাল গড়তে অনেক ক্ষেত্রেই বাড়তি সুবিধা পাচ্ছে। তার বাইরে অবস্থানগত কারণে সিআরবির এই জায়গাতে ইউনাইটেড হাসপাতাল করে ফেলতে পারলে বড় বিনিয়োগের ওই দুই হাসপাতালের বিনিয়োগ তুলে নেওয়াও অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। এসব কারণেই মূলত এসব কর্পোরেট গ্রুপ চায় না যে সিআরবিতে ইউনাইটেডের এই হাসপাতাল হোক।’

ওই নেতা বলেন, ‘এক্ষেত্রে আন্দোলনের মাধ্যমে সিআরবি থেকে এই হাসপাতাল সরানো গেলে আর যেখানেই এই হাসপাতাল হোক না কেন, তাতে ইউনাইটেড হাসপাতাল ব্যবসায় বাড়তি সুবিধা অন্তত পাবে না।’

এর বাইরেও এই হাসপাতালগুলোর মালিকানায় থাকা অনেককে নেপথ্যে থেকে সিআরবি রক্ষা আন্দোলন পরিচালনা করতে দেখা যাচ্ছে শুরু থেকে এবং ধারাবাহিকভাবে এই আন্দোলনটা এগিয়েও নিচ্ছেন তারা। ফলে এই অভিযোগটা বেশ শক্ত ভিতের ওপরই দাঁড়িয়ে যাচ্ছে।

অন্যদিকে সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মানের বিরোধিতা করে পাখির বাসা স্থাপনের প্রতীকী প্রতিবাদ কর্মসূচিতে নগর আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি খোরশেদ আলম সুজনকে শ্লোগান দিতে দেখা গেছে, ‘হাসপাতালের দোকানদারি নষ্ট লোকের পকেট ভারী।’ স্পষ্টভাবেই সেখানে সিআরবিতে ইউনাইটেড গ্রুপের এই হাসপাতালকে ‘দোকানদারি’ হিসেবে অভিহিত করে এই হাসপাতালের পক্ষে থাকা নেতাদের ‘নষ্ট লোক’ হিসেবে চিহ্নিত করে এর মাধ্যমে তাদের পকেট ভারী হচ্ছে বলেই ইঙ্গিত করেছেন সুজন।

এর পরপরই আন্দোলনে সক্রিয় কর্মীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণের পক্ষে থাকা কয়েকজন নেতাকে ইঙ্গিত করে লিখতে দেখা গেছে, ‘(উদ্দিন+উদ্দিন+উদ্দিন= ৬ কোটি)’। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন পোস্ট দেওয়া একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমরা শুনেছি হাসপাতালের বিপক্ষে হওয়া আন্দোলনকে থামিয়ে দিতে এর মধ্যে ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ৬ কোটি টাকা বাজেট করেছে। আমাদের তিন নেতা এর মধ্যে সেই চেষ্টা শুরু করেছেন। মূলত তারা ওই টাকার বিনিময়েই এই আন্দোলনের বিরোধিতা করছেন। এটাই বলতে চেয়েছি।’

তবে কারও লাভের জন্য হাসপাতাল নির্মাণের বিরোধিতা করার অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছেন ‘সিআরবি রক্ষায়’ নেতৃত্ব দেওয়া নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল। তিনি বলেন, ‘কারও স্বার্থে আমরা সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণের বিরোধিতা করছি না। আমরা যারা আন্দোলন করছি, তাদের সবাই জানে ও চিনে। অতীতেও আমরা চট্টগ্রামের স্বার্থে রাজপথে থেকেছি। মানুষের বিশ্বাসের সাথে কখনোই প্রতারণা করিনি। সেই জায়গা থেকেই সিআরবি রক্ষার এই আন্দোলন করছি। কারণ সিআরবি পরিবেশগত ও ঐতিহ্যগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটা জায়গা চট্টগ্রামের জন্য। এটা হেরিটেজ হিসেবেও সংরক্ষিত। এখন সেখানে হাসপাতাল না হলে কার লাভ হবে কার লস হবে সেটা আমরা দেখছি না। আমরা দেখছি সামগ্রিকভাবে চট্টগ্রামের লাভ হবে। আর হাসপাতাল নির্মাণের বিপক্ষেও আমরা না। আমরা শুধুমাত্র সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণের বিপক্ষে।’

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

আরও খবর

Video